গীবত সম্পর্কে বা গীবত কাকে বলে?
গীবত সম্পর্কে
যারা পাপ করে না এবং পাপ হতে যাদের নিরাপত্তা দেয়া
হয়েছে তাদের উচিত পাপী ও অবাধ্যগণের প্রতি করুণা প্রকাশ করা। কৃতজ্ঞতাই তাদের সবচেয়ে বড় পরিতৃপ্তি হওয়া উচিত এবং ইহা তাদেরকে অন্যের দোষ অন্বেষণ করা হতে রক্ষা করবে। গীবতকারীর অবস্থা কী, যে তার ভাইকে দোষারোপ করে এবং তার দোষ খুঁজে বেড়ায়? সে কি ভুলে গেছে যে, আল্লাহ্ তার পাপ গোপন করে রেখেছেন যা তার ভাইয়ের পাপ হতেও গুরুতর? যেখানে সে নিজেই পাপে লিপ্ত সেখানে সে কি করে অন্যকে পাপের জন্য নিন্দা করবে? যদি সে অন্যের সমান পাপ নাও করে থাকে তবুও সে যে বড় ধরণের পাপ করেনি উহার নিশ্চয়তা কোথায়? আল্লাহ্র কসম, যদি সে কবিরা গুনাহ্ না করে সগিরা গুনাহ্ও করে থাকে তবুও অন্যের গুনাহ্ চর্চা করে সে কবিরা গুনাহ্ই করলো।
হে আল্লাহ্র বান্দাগণ, তোমরা অন্যের পাপ-চর্চায় তাড়াহুড়া করো না, কারণ সে হয়তো ইহার জন্য কক্ষা পেয়ে যেতে পারে এবং তোমার নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাপের জন্যও নিজেকে নিরাপদ মনে করো না, কারণ তোমাকে হয়ত উহার জন্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যের দোষ জানতে পারলে তা প্রকাশ করা উচিত নয় কারণ তার চিন্তা কার উচিত সে নিজের দোষ কতটুকুই বা জানে। তদুপরি তার উচিত শুকরিয়া আদায় করা এ জন্য যে তকে এহন পাপ হতে রক্ষা করা হয়েছে।
১। অন্যের ছিদ্রান্বেষণ ও গীবত এমনভাবে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, মানুষ ইহার কুফল বেমালুম ভুলে আছে। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, বড় ও ছোট, সম্ভ্রান্ত ও নীচ কেউ এ দোষ মুক্ত নয়। মিম্বারের উচ্চ মর্যাদা বা মসজিদের পবিত্রতা কোন কিছুই এ দোষ নিবৃত্ত করতে পারছে না। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব একত্রে বসলেই তাদের আলোচনার বিষয়বব্তু হয়ে দাঁড়ায় অতিরঞ্জিত করে অন্যের দোষ করে কুৎসা রটানো। ছিদ্রান্বেষী লোকের শত দোষ থাকলেও সে নিজের দোষ প্রকাশ হোক এটা কখনো চায় না, কিন্তু সে অন্যের দোষক্রটি খুঁজে বেড়ায় এবং রসিয়ে তা প্রকাশ করে। নিজের জন্য যেমন অন্যের জন্য ঠিক তদ্রূপ অনুভূতি থাকা উচিত। অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করে কারো কিছু করা উচিত নয়। এ প্রবাদ সকলেরই মেনে চলা উচিত যে, “তুমি অন্যের কাছ থেকে যা আশা কর না, অন্যের প্রতিও তুমি তা করো না।”
গীবতের সংজ্ঞা হলো, কথায় হোক আর কর্মেই হোক মানহানী করার উদ্দেশ্যে কারো দোষ প্রকাশ করা যা তার দুঃখের কারণ হয়ে দাড়ায়। কেউ কেউ বলেন, গীবত হবে ইহাই যাহা মিথ্যামিথ্যি ও সত্যের বিপরীতভাবে প্রকাশ করা হয়। তাদের মতে যা দেখেছে বা শুনেছ তা অবিকল প্রকাশ করা গীবত নয়। তারা বলে তারা তো যা দেখেছে বা শুনেছে উহাই প্রকাশ করেছে- এত গীবত হবে কেন? বস্তুতঃ এহেন বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করার নামই হলো গীবত কারণ ঘটনাটি যদি তথ্যগতভাবে মিথ্যা হতো তবে তা হতো কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করা- গীবত নয়। বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ
“তোমরা কি জান গীত কী?” লোকেরা বললো, “আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন।” তৎপর তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের ভাইদের সম্বন্ধে কিছু বললে যদি সে ব্যথিত হয়- উহাই গীবত।” কেউ একজন বললো, “যদি আমি তার সম্বন্ধে যা বলি তা প্রকৃত পক্ষেই সত্য তাহলে কি হবে?” রাসুল (সঃ) জবাব দিলেন, “গীবত হবে তখনই যখন তথ্যগতভাবে উহা সত্য হয়। অন্যথায় উহা মিথ্যা অপবাদ হবে।”
গীবত নানা কারণে করা হয়ে থাকে, সে কারণে মানুষ কখনো জ্ঞাতসারে আবার কখনো অজ্ঞাতসারে গীবতে জড়িয়ে পড়ে। আবু হামিদ আল-গাজ্জালী তার গ্রন্থ ‘এহ্হিয়া উলুমদ্দীন”-এ গীবতের বিস্তারিত কারণ উল্লেখ করেছেন। উহার প্রধান প্রধানগুলি নিম্নরূপঃ
১. কারো সম্বন্ধে কৌতুক করা বা কারো মানহানি করার জন্য;
২. মানুষকে হাসাবার জন্য এবং নিজেকে হাস্য-রসিকতা ও প্রাণ-চাঞ্চল্য প্রকাশ করার জন্য;
৩. ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজেকে অনুভূতি প্রকাশের জন্য;
৪. অন্যের বদমান করে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য;
৫. কোন বিষয়ে নিজেকে সংশ্লিষ্টতা ঢেকে রাখার জন্য, যেমন-কোন অপরাধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া;
৬. কোন দলের সাথে জড়িত থেকেও উহা ধামা চাপা দেওয়া;
৭. কোন লোককে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য যার কাছ থেকে নিজেকে দোষ প্রকাশিত হয়ে পড়ার ভয় থাকে;
৮. প্রতিযোগীকে পরাভূত করার জন্য;
৯. ক্ষমতাসীন কারো কাছে নিজের স্থান করে নেয়ার জন্য;
১০. অমুক ব্যক্তি অমুক পাপে লিপ্ত হয়েছে- এরূপ কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করা জন্য;
১১. বিস্ময় প্রকাশ করার জন্য, যেমন- অমুক ব্যক্তি এ কাজ করেছে;
১২. কোন কাজে ক্রোধ প্রকাশ করে কাজটি যে করেছে তার নাম প্রকাশ করার জন্য। তাবে কোন কোন ক্ষেত্রে ছিদ্রান্বেষণ বা সমালোচনা গীবত হয় না, যেমন-
(১) অত্যাচার হতে নিষ্কৃতি পাবার জন্য মজলুম জালেমের বিরুদ্ধে নালিশ করে গীবত হয় না, যেমন আল্লাহ্ বলেন, মন্দ কথায় প্রচারণা আল্লাহ্ পছন্দ করেন না; তবে যার ওপর জুলুম করে হয়েছে তার কথা স্বতন্ত্র; (কুরআন-৪:১৪৮)
(২) অন্যকে উপদেশ দেয়ার জন্য কারো দোষ উহাহরণ হিসাবে প্রকাশ করলে গীবত হয় না;
(৩) দ্বীনের অনুশাসন বলবৎ করার জন্য কারো বিশেষ দোষ প্রকাশ করলে গীবত হয় না;
(৪) কোন মুসলিমকে ক্ষতির হাত হতে রক্ষা করার জন্য আত্মসাৎ ও অসাধুতার কথা প্রকাশ
করলে গীবত হয় না;
(৫) এমন কারো কাছে দোষ প্রকাশ করা যিনি বাধা দিয়ে দোষ হতে রক্ষা করতে পারবেন;
(৬) হাদীসের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বর্ণনাকারীর সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ
করলে গীবত হয় না;
(৭) কারো শারীরিক সীমাবদদ্ধতা (যেমন-বোবা, অন্ধ, কালা, হাতবিহীন) ব্যক্তিত্ব ব্যাখ্যার
জন্য প্রকাশ করা গীবত নয়;
(৮) চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসার জন্য দোষ প্রকাশ করা গীবত নয়;
(৯) কেউ মিথ্যা বংশ পরিচয় দেল তার সঠিক বংশ পরিচয় প্রকাশ করলে গীবত হয় না;
(১০) কারো জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তার দোষ প্রকাশ করলে গীবত
হয় না;
(১১) যদি দু’ব্যক্তি কারো দোষ আলোচনা করে যা উভয়েরই জানা আছে তা গীবত হয় না;
(১২) যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে কুকর্ম করে তার আচরণ প্রকাশ করলে গীবত হয় না; যেমন হাদীসে
আছে; “যে লজ্জার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেলেছে তার বেলায় গীবত নেই।”
নাহ্জ আল-বালাগা
আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব
সংঙ্কলনঃ আশ-শরীফ আর-রাজী
বাংলা অনুবাদঃ জেহাদুল ইসলাম
বাংলা অনুবাদঃ জেহাদুল ইসলাম
ইংরেজি অনুবাদঃ সৈয়দ আলী রেজা
খোৎবা-১৩৯ পৃষ্ঠা নং ১৬৩-১৬৪।
No comments