Banners

মাওলা পাকের দয়া


মাওলা পাকের দয়া ও মানুষের উপর ভালবাসা


১. একবার পশ্চিমদেশে ভ্রমণ করার সময় তাঁর একমাত্র খাদেম গোলাম সোব্হানী ভীষন কলেরা রোগে  আক্রান্ত হয়সেখানে কয়েক টাকা খরচ করলে সেবা শুশ্রুষা করার জন্য বহু লোক পাওয়া যেত; কিন্তু হুজুর নিজে তার সেবা শুশ্রুষা করতে লাগলেন, তার কাপড় চোপড় বদলে দিতে লাগলেন, ব্যাপার দেখে গোলাম সোবহানী কেঁদে ফেলল এবং হাতজোড় করে হুজুরকে দিবেদন করল, “হুজুর আপনি অনুগ্রহ করে কাজ করবেন নাএকথা শুনে হুজুর উত্তর দিলেন, - গোলাম সোবহানী, এটা কলকাতা নয়; এখানে দশ বার টাকাতে তিন চারজন লোকও পাওয়া যায়, কিন্তু এখন আমি যদি তোমাকে তাদের হাতে ছেড়ে দিই তাহলে খুব অন্যায় হবেবল দেখি, তোমার মত আমার এরকম অবস্থা হত তুমি কি করতে? এই বলে উত্তরের কোন অপেক্ষা না করে তিনি পূর্ববৎ তার সেবাযত্ন করতে লাগলেন

ওলী আল্লাহ, মাওলা পাক, মাওলা পাকের দয়া, জোড়া মসজিদ, কাদেরিয়া তরিকা২. একবার তাঁর পিতার এক শিষ্য (মুরীদ) তাঁর কাছে অভিযোগ করেন যে, সে দরিদ্র বলে তার প্রতিবেশীরা তাকে খুব ঘৃনা করেহুজুর তক্ষনি উঠে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আজ হতে তুমি আমার ভাইসেদিন থেকেই সেই ব্যক্তি যতদিন জীবিত ছিল হুজুর তাকে নিজের ভাইয়ের মতই দেখতেনএমনকি সে উপস্থিত না থাকলেও তার নামোল্লেখ না করে ভাই বলেই অপরের নিকট তার উল্লেখ করতেন
সকলের প্রতিই তাঁর উদারতা অনুগ্রহ সমভাবে দৃষ্ট হত; ধনী, দরিদ্র, দীন কিন্বা কুষ্ঠারোগগ্রাস্ত ব্যাক্তিতে পযন্ত তিনি একই ভাবে আলিঙ্গন বা বুকে জড়িয়ে ধরতে কিছুমাত্র সংকোচ বা দ্বিধাবোধ করতেন না

৩. একবার মুর্শিদাবাদ নিবাসী এক কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি হুজুরের কাছে উপস্থিত হল  হুজুর উঠে গিয়ে আলিঙ্গন করার পর তার হাতদুটি নিজের হাতে ধরলেনতার হাতের  তুলু দুটি পূঁজে ভরা ক্ষত বিক্ষতকিন্তু হুজুর তার হত দুটি ধরে ধীরভাবে তার দুঃখেপূর্ণ করুন কাহিনী শুনলেনশেষে আশ্বাস দিয়ে তার কাষ্টের নিবারন করলেন
আর একবার ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্থ সে হুজুরের মুরীদ হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলোমুরীদ হবার সময় নিয়ম এই, যে ব্যক্তি দীক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, তাকে পীরের অর্থাৎ গুরুর দক্ষিণ হাতখানি নিজের দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে গুরু যে কথাগুলি উচ্চারণ করেন তাহাই উচ্চারণ করতে হয়
ইউসুফের হাতদুটি পূঁজ, রক্ত ক্ষতে পরিপূর্ন থাকায় তার শিক্ষক হাফেজ আব্দুল গফুর এইরূপ ব্যবস্থা করলেন যে গফুর হুজরা পাকের বাইরে বসবে এবং মহিলারা দীক্ষা নেবার সময় যে রূপ একখানি কাপড়ের এক প্রান্ত ধরে থাকে সেও সেই রকম কাপড়ের একপ্রান্ত ধরবে এবং হুজুর যে বচন উচ্চারণ করবেন সেও তাই  উচ্চারণ করবেকিন্তু হুজুর ইউসুফেকে তাঁর কাছে আনতে আদেশ দিলেন এবং ইউসুফ হুজরা পাকে উপস্থিত হলে হুজুর স্বয়ং নিজের হাতখানি ইউসুফের হাতে রেখে যথানিয়মে তাকে দীক্ষা দান করলেন

৪. হুজুর মানুষের দুঃখ কষ্টের প্রতি খুব নজর দিতেনতিনি নিজে প্রাণপন চেষ্টা করে অপরের দুঃখ- কষ্টকে লাঘব করতেনমেদিনীপুরে তাঁর পৈতিক বাসভবনে একটি ছাত্র বাস করতএক সময় সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সেখানকার বাসিন্দারা তাকে এক নির্জন স্থানে রেখে আসেনহুজুর তখন ইস্ত্রিগঞ্জে ছিলেনএই খবর তাঁর কানে পৌঁছানো মাত্র তিনি ছাত্রটির কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে নিজের হুজরা খানায় (সাধন কক্ষে) নিয়ে এলেন এবং নিজ শয্যার পাশে তার শয্যা রচনা করে পিতৃস্নেহে তার সেবা শুশ্রুষা করতে লাগলেনকয়েক দিন বাদে সেখানেই ছেলেটি মারা যান
হুজুর কখনও কার অন্তরে ব্যাথ্যা প্রদান করেন নি, হুজুরের অন্তর ছিল খুব কোমল মধুরকারুর সামান্য আঘাত বা কষ্ট দেখলেই তাঁর মন ব্যথিক হয়ে উঠততাঁর সহানুভূতি আর্শবিাদ পাবার আশায় ক্ষতজর্জরীত ব্যক্তিরা তাঁর কাছে এসে তাঁর সামনে ক্ষতস্থান উন্মেচন করত এবং তার ফলও সঙ্গে সঙ্গেই ফলতবুহু চিকিৎসাতে সে ক্ষত বা আঘাত একটুও ভাল হয় নি, তা খুব শিঘ্রই সেরে উঠত
হুজুর কখনও কারও মনে কষ্ট দিতেন না, তিনি বলতেন মহাপাপ

৫. একবার এক অতিথি (মুসাফির) হুজুরের কলকাতার বাড়ী থেকে কিছু জিনিস চুরি করেযেখানে যারা উপস্থিত ছিল তারা সেই অতিথিকে খুব গালি গালাজ প্রহার করে; ফলে সেই ব্যক্তি জিনিসগুলো ফেরৎ দেয়এরপর তারা তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়হুজুর সে সময় কলকাতায় ছিলেন না, পরে বিষয়ে সব জানতে পেরে খুব ব্যথিত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেনতিনি বললেন, “চুরি করা মহাপাপ সত্য, কিন্তু কোন ব্যক্তিকে অপমান কার আদৌ ক্ষমা করা যায় না

হুজুরের দানশীলতার সীমা ছিল নাপ্রতি মাসেই তিনি প্রচুর অর্থদান করতেনকায়েকজন ব্যক্তির নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল; কেউ কেউ মাঝে মাঝে প্রয়োজন মত অর্থ পেত আবার কাউকে বা অতি গোপনে তিনি প্রচুর অর্থ দান করতেনঅনাথ, বিধবা নিরাশ্রয় মাতৃপিতৃহীন বালক বালিকার প্রতি তাঁর বিশেষ  লক্ষ্য ছিলতিনি একজন উদারহৃদয় ছাত্র বন্ধু ছিলেন, - বহু ছাত্র খান্কা শরীফে খাওয়া এবং সময় মত ফলমূল আহার করতহুজুরের অনেক অনুচর ছিল; তিনিই তাদের ভরণ পোষণের দায় বহন করতেনসামান্য কিছু কাজ করেই তারা খাওয়া-দাওয়া খেত এবং বাড়ী যাবার সময় হুজুর তাদের পরিবার বর্গের জন্য এবং পথের খরচ বাবদ প্রচুর অর্থদান করতেন তাদের
ধর্মসংক্রান্ত ব্যপারেও হুজুরের দান ছিল অপরিসীমএকবার পাটনায় অবস্থান কালে তিনি সেখানকার প্রসিদ্ধ বা নাম করা মর্শিয়া খাঁ গোলাম ইমাম শহীদকে নিমন্ত্রন করে এন তাকে মর্শিয়া শরীফ পাঠের জন্য অনুরোধ করেন ব্যক্তি প্রত্যেক মর্শিয়া শরীফ পাঠের জন্য একশ থেকে দুইশত টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেতেন; কিন্তু হুজুরের কাছে যখনা তার মর্শিয়া পাঠ সমান্ত হল, হুজুর তাকে নিজের কাছে ডেকে এনে গোপনে পাঁচশ টাকা প্রদান করেনএত টাকা হুজুর তাকে দিয়েও হুজুর তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন এখন তিনি প্রবাসে, নইলে আরও অধিক অর্থ তিনি তাকে দিতেন
হুজুর আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে তাঁর শ্রীচরণে হুজুর যে ভাবে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন তা খুবই আশ্চর্য জনকহুজুর বলতেন- “আমার খাদ্য ইন্ধন পযন্ত আসে বাগদাদ থেকে পরমেশ্বরের কাছ থেকে আমি তা পেয়ে থাকি

৬. একবার, আজমির শরীফে সেখানকার খাদেম তাঁকে কাতর মিনতি করে অনুরোধ জানার – “হুজুর আপনি এখানে সামান্য দোওয়া  চান উত্তরে হজুর বললেন – “আমার এখানে কোন দোয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ আমি একজন বাগদাদী, আর যিনি ওলি ও কুতুবকুলের অধীশ্বের সেই বাগদাদ অধিপতি আমার সকল অভাব পূরণ করে থাকেনতিনি, আজমের মহাসাধক হজরত সুলতান--হিন্দের কিছুমাত্র মুখাপেক্ষী কিম্বা কৃপাপ্রার্থী ছিলেন না তাই তাঁর মুখেই এরূপ সাহসগর্ভ উক্তি শোভা পায় হজরত গাওস-উল-আজম, যাঁর পবিত্র চরণ যুগল সকল ওলি ও কুতুবের স্কন্ধে, হুজুর ছিলেন তাঁরই পূর্ণ প্রতিরূপ হুজুর বলতেন- আমার নিজের কোন সত্তা নেই, আমি গওস-এ হকের প্রতিবিম্বমাত্র হজরত মহাম্মদের শ্রীচরণে হজরত গওস-পাকের ঐকান্তিক আত্ম সমর্পন সর্বজনে বিদিত (সবার জন্য)

৭. পিন্স বখতিয়ার সাহেবের ফুপু (পিসি), মহীশূর রাজপরিবারের বেগম সাহেবা অতুল বা প্রচুর সম্পদের অধীশ্বরী ছিলেন  তিনি হুজুরকে তাঁর সমস্ত সপ্তত্তিই উপহার দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন উত্তরে হুজুর বলেন- বেগম সাহেবা, আপনার সদিচ্ছার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই আল্লাহ আপনাকে দেওয়া (আর্শীবাদ) করুক কিন্তু আমি সম্পত্তি নিয়ে কী করব? আপনি এই সম্পত্তি এখন ভোগ করুন, আপনার অবর্তমানে আপনার উত্তরাধিকারীরা এই সম্পদ ভোগ করবেন এবং উপকার পাবেন
হুজুর একবার প্রবল জ্বর: পিপাশায় তাঁর কণ্ঠ ও ওষ্ঠ শুষ্কপ্রায় তখন তাঁর এক প্রিয় শিষ্য তাঁকে ডাব এন দিলে সেই ডাবের পনি হুজুর গ্রহন করলেন না, কারণ ডাবটি কিনে আনা হয় নি, - তাঁর প্রিয় শিষ্য ডাবটি নিকটবর্তী এক জমিদারের বাড়ি থেকে পেয়ে এনেছিলেন
একবার হুজুরে একটি ষ্টেভের বিশেষ প্রয়োজন হয় তখন মৌলানা আবু তাহের সাহেব হুজুরের এক ধনী শিষ্যের (মুরিদান) কাছ থেকে একটি উৎকৃষ্ট ও মূল্যবান ষ্টোভ সংগ্রহের চেষ্টা করেন হুজুর তা জানতে পেরে ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে উঠলেন এবং বললেনমৌলভী সাহেব, আপনার কি ইচ্ছে আমি একজন সামান্য ভিক্ষুক হই? মৌলভি সাহেব বললেন - “হুজুর আমি ওটা নিজের নাম করে চেয়েছি তখন হুজুর বললেন – “আমার জন্যই চান আর আপনি নিজের নাম করেই চানসে একই কথা তখনই সে মতলব ত্যাগ করতে হয়
পার্থিব ঐশ্বযের প্রতি হুজুরের কোন আসক্তি ছিল না তিনি বলতেন –“প্রয়োজনীয় খরচ পত্রের জন্যই অর্থের প্রয়োজন; নইলে অর্থের কোনই প্রায়োজন নেই, আর খরচ পত্র যত কম হয়, ততই মঙ্গল

৮. কয়েকজন ব্যক্তি তাঁর প্রতি বিষ প্রয়োগেরও চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি তাদের সকলকেই ক্ষমা করেন তিনি বলতেনঅপরের প্রাণ নষ্ট করতে চাওয়া বা ক্ষতি করা মহা পাপ, এবং তা ক্ষমার অযোগ্য; আল্লাহ আর সকল পাপই ক্ষমা করে থাকেন
হুজুর, নিষ্ঠার ও দৃঢ় অনুরাগের ভূয়সী প্রশংসা করতেন এবং বলতেন- দৃঢ় ভক্তিই ধর্ম, ভগবৎ সেবা অথবা জন- সেবা ছাড়া কোন কর্মই সাধিত হতে পারে না
মুরীদ অর্থাৎ শিষ্যবর্গ কে একমাত্র পীরের প্রতি তাদের ভক্তি ও অটল বিশ্বাস রাখতে হবে পীর এবং ওলি অমর কায়মনোকাকাক্যে পীরের ধ্যান ও সঙ্গলাভ করবে (পীরের) ধ্যানই স্বর্গের আলোক স্বরূপ
কিতাবঃ মাওলা পাক (আঃ) সংক্ষিপ্ত জীবনী (আবুল হাসনাত কাদেরী) জিলানী প্রকাশনী

No comments

Powered by Blogger.